
গাজীপুরের সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে হত্যার সূচনা হয়েছিল একটি ‘হানিট্র্যাপ’ থেকে। নারী ঘটিত বিষয়ে সন্ত্রাসী হামলা ঘটনার ভিডিও ধারণ করায় ওই সাংবাদিককে বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাতে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে কুপিয়ে ও গলা কেটে খুন করেছে দুর্বৃত্তরা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রাতেই ঘটনাস্থলের আশপাশে অভিযান চালিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে আটক করেছে। সিসিটিভি ফুটেজের সাথে মিলিয়ে তাদের শনাক্তকরণের কাজ চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ঘটনায় গোলাপি নামের এক নারীকে খুঁজছে পুলিশ।
সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় শুক্রবার (৮ আগস্ট) গাজীপুরে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা করেছে বিভিন্ন সংগঠন।
অপর ঘটনায়, গাজীপুর মহানগরের সদর থানার কাছে প্রকাশ্যে এক সাংবাদিককে বেদম মারধর এবং ইট দিয়ে পা থেঁতলে দেয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগীর মা আনোয়ারা সুলতানা বাদী হয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগে তিনি দাবি করেন চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় তার ছেলের ওপর মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ একজনকে আটক করেছে। বুধবার (৬ আগস্ট) বিকেল ৫টার দিকে দৈনিক বাংলাদেশের আলো পত্রিকার সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনের ওপর এই নির্যাতন চালানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও বৃহস্পতিবার ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাতে গাজীপুর মহানগরীর বাসন থানাধীন চান্দনা চৌরাস্তা মোড়ের ঈদগাহ মার্কেট এলাকায় গোলাপি নামে এক নারী বাদশা নামের একজনকে প্রলোভনে (হানিট্র্যাপ) ফেলে। তার সাথে থাকা সশস্ত্র যুবকরা বাদশাকে চাপাতি দিয়ে কোপাতে থাকে। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে মোবাইলে দৃশ্যটি ধারণ করছিলেন সাংবাদিক তুহিন। এ সময় হামলাকারীরা তার ওপর চড়াও হয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। পুলিশ ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল এলাকা থেকে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করছে।
সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, কালো জামা পরা এক নারী (গেলাপী) রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। হঠাৎ নীল শার্ট পরা এক ব্যক্তি (বাদশা) ওই নারীকে টেনে ধরে। এসময় চলে যেতে চাইলে ওই নারীর পথরোধ করে এবং এক পর্যায়ে তাকে থাপ্পড় মারে বাদশা। মুহূর্তেই চাপাতি, রামদা ও চাইনিজ কুড়ালসহ কয়েকজন যুবক ওই ব্যক্তির দিকে ধেয়ে আসে এবং তাকে কোপাতে থাকে। পরে ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তিটি দৌঁড়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।
এ সময় সাংবাদিক তুহিন মোবাইলে ওই দৃশ্য ধারণ করতে থাকলে সন্ত্রাসীদের নজর তার দিকে যায়। তারা সাংবাদিক তুহিনকে ধাওয়া করে। প্রাণ রক্ষার জন্য সাংবাদিক তুহিন দৌড়ে পাশের চান্দনা চৌরাস্তা ঈদগাহ মার্কেটের একটি দোকানে আশ্রয় নেন। ফুটেজে দেখা গেছে, দাঁড়িওয়ালা ও মাথায় ক্যাপ পরা ফয়সাল ওরফে কেটু মিজান চাপাতি হাতে দৌঁড়াচ্ছে। তার সাথে শাহজামাল, বুলেট ও সুজনসহ আরো কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাকিদের পরিচয় উদ্ঘাটনের জন্য কাজ চলছে।
নিহত তুহিনের সহকর্মী সাংবাদিক মো: শামীম জানান, আমরা দু’জন পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি কয়েকজন অস্ত্র হাতে দৌড়াচ্ছে, তুহিন তখন ভিডিও করতে শুরু করে, এরপর সন্ত্রাসীরা তার দিকে ধেয়ে যায়। প্রাণ বাঁচাতে তুহিন একটি দোকানে ঢুকে পড়েন। কিন্তু সন্ত্রাসীরা সেখানে ঢুকেই তাকে নির্বিচারে কুপিয়ে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পুলিশকে খবর দেয়ার আগেই সব শেষ হয়ে যায়।
হামলাকারীদের মূল টার্গেট বাদশা জানান, ওই মেয়েসহ একটি দল আগে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশের ধারণা, এটি একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্র, যারা বাসন, ভোগড়া ও চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় সক্রিয়, সিসিটিভিতে ধরা পড়া নারীসহ মিজান ওরফে কেটু মিজান, শাহ জামাল, বুলেট ও সুজন এই চক্রের সক্রিয় সদস্য।
স্থানীয়রা জানান, চান্দনা চৌরাস্তাসহ বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে এক শ্রেণির নারী পথচারী বিভিন্নজনকে প্রলোভন দেখিয়ে কাছে ডেকে নেয়। এসময় ওই নারীর সাথে আশেপাশে ওৎপেতে থাকা ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এগিয়ে এসে ওই ব্যক্তিদের মারধর করে এবং সর্বস্ব কেড়ে নেয়। প্রকাশ্যে এসব ঘটনা ঘটলেও ভয়ে ওই ব্যক্তিদের উদ্ধারে কেউ এগিয়ে যায় না। এমনকি আশেপাশে পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) উপ-সহকারি কমিশনার রবিউল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর জনৈক বাদশা মিয়া গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার বহুতল বিপণীবিতান শাপলা ম্যানশনের সামনে গোলাপি নামের এক মহিলাকে কিল ঘুষি মারছিলেন। এ সময় মহিলার সাথে থাকা কয়েকজন যুবক চাপাতি ও ছুরি দিয়ে বাদশা মিয়ার ওপর হামলা চালায়। আহত বাদশা মিয়া ঘটনাস্থল থেকে দৌঁড়ে পালিয়ে যান। এসময় মহিলার ওপর বাদশাহ মিয়ার হামলা এবং পরবর্তীতে বাদশা মিয়ার ওপর সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনার দৃশ্য একটু দূরে দাঁড়িয়ে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করছিলেন প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুরের সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন। হামলাকারীরা তুহিনকে ভিডিও ধারণ না করতে বলে এবং ধারণকৃত ভিডিও ডিলিট করতে বলে। এক পর্যায়ে আসাদুজ্জামান তুহিন ঘটনাস্থল থেকে চলে যেতে থাকলে হামলাকারীরা তাকে অনুসরণ করে ধাওয়া করে। তুহিন দৌঁড়ে পাশের ঈদগাহ মার্কেটের চা-পান বিক্রেতা জনৈক রুহুল আমিনের দোকানে গিয়ে আশ্রয় নেন। হামলাকারীরা সেখানে গিয়ে জনসম্মুখে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে বুকে, গলায়, কাঁধে ও পিঠে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার গলার কিছু অংশ কেটে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতবিক্ষত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তুহিন। এদিকে ঘটনার পর আহত বাদশা মিয়া গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
শুক্রবার অজ্ঞাতদের আসামি করে বাসন থানায় মামলা করেছেন। হামলাকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের ধরার জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবার ময়নাতদন্ত শেষে নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের লাশ তার বড় ভাই সেলিম মিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়। দুপুরে জুমার নামাজের পর চান্দনা চৌরাস্তার ঈদগাহ মাঠে তার জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। পরে তার বড় ভাই সেলিম মিয়া লাশ গ্রহণ করে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় পারিবারিক গোরস্থানে দাফনের জন্য নিয়ে যায়।
নিহত মো: আসাদুজ্জামান তুহিন (৩৬) ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার ভাটিপাড়া গ্রামের হাসান জামালের ছেলে। তিনি স্ব-পরিবারে গাজীপুরে থেকে দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুর প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ) রবিউল হাসান বলেন, ‘সাংবাদিক তুহিন হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে রাতেই ঘটনাস্থলের আশপাশে অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজের সাথে মিলিয়ে এদের শনাক্তকরণের কাজ চলছে। আমরা খুব সতর্কতার সাথে কাজ করছি যেন কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি এই মামলায় জড়িয়ে না যায়।
তিনি জানান, পুলিশের একাধিক টিম এখনো পলাতক ওই নারী গোলাপিকে এবং চিহ্নিত আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চালাচ্ছে। পুলিশ ও অন্য সংস্থার গোয়েন্দা বিভাগের তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।
গোয়েন্দা পুলিশের ধারণা, এটি একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। যারা বাসন, ভোগড়া ও চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় সক্রিয়। সিসিটিভিতে ধরা পড়া নারীসহ মিজান ওরফে কেটু মিজান, শাহ জামাল, বুলেট ও সুজন এই চক্রের সক্রিয় সদস্য। ঘটনার সময় হামলাকারীদের মূল টার্গেট ছিল বাদশা মিয়া নামে এক ব্যক্তি, যিনি বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
সাংবাদিক আনোয়ার নির্যাতনের ঘটনায় সাংবাদিকের মায়ের দায়ের করা অভিযোগ থেকে জানা গেছে, গাজীপুর শহরের সাহাপাড়া এলাকায় ইজিবাইক ও সিএনজি চালিত অটোরিকশা থেকে চাঁদাবাজির সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তার ছেলে হামলার শিকার হয়েছেন। হামলাকারীরা তার ছেলে কাছ থেকে দুটি মোবাইল ফোন ও নগদ ২৬ হাজার ২৫০ টাকা ছিনিয়ে নেয়।বাসন থানা এলাকায় সাংবাদিক তুহিন হত্যা এবং আগের দিন (বুধবার) সদর থানা
র পাশে আনোয়ার হোসেন নামে অপর এক সংবাদকর্মীকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে গুরুতর আহত করার ঘটনা ঘটেছে। হামলাকারীরা আনোয়ারকে নির্মমভাবে মারধর করে এবং তার বুকের ওপর উঠে লাফায়।এসময় ইট দিয়ে তার পা থেঁতলে দেয় এবং টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় হাম
লাকারীরা। ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও তারা আশানুরূপ কোনো হস্তক্ষেপ করেননি বলে অভিযোগ উঠেছে।
হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, আনোয়ারের পায়ে গুরুতর জখম হয়েছে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ঘটনায় আনোয়ারের মা আনোয়ারা বাদী হয়ে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে সদর থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।গাজীপুর সদর থানার ওসি মেহেদী হাসান
জানান, ভিডিও ফুটেজ দেখে ফরিদ নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্ত চলছে এবং বাকি আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।
গাজীপুরে পরপর দুইদিনে সাংবাদিকদের ওপর হামলার দুইটি ঘটনার প্রতিবাদে গাজীপুরে সাংবাদিকসহ সকল মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এসব ঘটনার প্রতিবাদে ও আইন শৃঙ্খলা অবনতির অভিযোগে শুক্রবার গাজীপুর প্রেস ক্লাবের সামনে সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণ অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠণ মানববন্ধন, বিক্ষোভ, সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাতেও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজীপুর নগর শাখার নেতা-কর্মীরা তাৎক্ষণিকভাবে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করেছে।
এছাড়াও গাজীপুর প্রেস ক্লাব, জামায়াতে ইসলাম, বিএনপিসহ বিভিন্ন সংগঠন সাংবাদিক তুহিন হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও অবিলম্বে খুনিদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন।